মহামারিতে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থার উত্থান

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পর্যুদস্ত পুরো বিশ্ব। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইউরোপ। এই সংকটকালে ইউরোপজুড়ে যেমন স্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি উল্লেখযোগ্য হারে উগ্র-ডানপন্থারও উত্থান ঘটেছে।

মহামারির আগে থেকেই উগ্র-ডানপন্থা নিয়ে চিন্তিত ইউরোপ। তবে মহামারিতে তা আরও দ্রুততার সাথে ও শক্তিশালীভাবে সামনে এসেছে।

কাতালোনিয়ার স্থানীয় নির্বাচনের জন্য গত ২৮ জানুয়ারি প্রচারণা শুরু করেন সেখানকার উগ্র-ডানপন্থী দল ভক্সের অন্যতম প্রার্থী ইগনাসিও গারিগা। অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতন্ত্রী পার্টির সালভাদর ইলাকে লক্ষ্য করে তিনি এই আক্রমণাত্মক প্রচারণা শুরু করেন। 

তিনি বলেন, ‘মহামারিকে অবহেলা ও অপরাধমূলক পরিচালনার পেছনে রয়েছেন অযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সালভাদোর ইলা। এই ব্যবস্থাপনাকে দুটি শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়- মৃত্যু ও ধ্বংস। আমি আবারো এ কথাটি বলতে চাই, কারণ আপনাদের অনেকেই বহুদিন ধরে বাড়িতে টিভি সেটের সামনে বসে দেখছেন আর বলছেন- মৃত্যু ও ধ্বংস।’

উল্লেখ্য, সম্প্রতি সালভাদর ইলা কভিড-১৯ মোকাবেলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

কভিড-১৯ শুধু স্বাস্থ্যগত কোনো সংকট নয়, বরং মানুষের আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও এর নির্মম প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ভক্সের মতো উগ্র-ডানপন্থী দলগুলো সবসময়ই যেকোনো সংকটের জন্য তাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করে থাকে। এ বিষয়টি বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মহামারিতে অতীষ্ঠ হয়ে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের মতো কাতালোনিয়ায়ও ভোটারদের একাংশ উগ্র-ডানপন্থীদের সমর্থন দিচ্ছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৭.৬ শতাংশ ভোট ও ১১টি আসন নিয়ে ভক্স রয়েছে চতুর্থ স্থানে। ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৩ শতাংশ।

তবে উগ্র-ডানপন্থার সংকট কিন্তু মোটেও নতুন ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা দেখা যায়- চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারলেও উগ্র-ডানপন্থী নব্য-নাৎসি দলের উত্থান ঘটছে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে হাজির হয় তারা। ডেনমার্কে ২০১৫ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল মধ্য-ডানপন্থী জোট। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনেও উত্থান ঘটে উগ্র-ডানপন্থীদের। শরণার্থী ইস্যুকে সামনে রেখে তরুণদের উত্তেজিত করতে বেকারত্বসহ বিভিন্ন বিষয় সামনে আনছে উগ্র-ডানপন্থীরা। 

ডেমোক্র্যাট দলগুলোর মধ্যে এসব ইস্যুতে মতভিন্নতা রয়েছে। ফলে তারা এ নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকছে। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে উগ্র-ডানপন্থীরা। যুক্তরাজ্যের অবস্থাও খুব ভিন্ন নয়। সেখানে লেবার পার্টির ভরাডুবি ও দলটি থেকে জেরেমি করবিন ও তার অনুসারীদের ছুড়ে ফেলাটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কার্যত এখন রক্ষণশীল পার্টি ও লেবার পার্টির নেতাদের বক্তব্যে অমিল খুব সামান্যই। আর এতে নাইজেল ফারাজদের মতো উগ্র-ডানপন্থীদের উত্থান ঘটছে খুব দ্রুত।

এদিকে, পর্তুগালে সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। সেখানে উগ্র-ডানপন্থি চেগা পার্টি মোট ভোটের প্রায় ১১.৯ শতাংশ পেয়েছে। যা ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন থেকে প্রায় ১.৩ শতাংশ বেশি। 

ইউরোপের অন্যদিকের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। রোমানিয়ায় গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে উগ্র-ডানপন্থী সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর দ্য ইউনিটি অব রোমানিয়ানস (এইউআর) হঠাৎ করেই বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই নির্বাচনে তারা ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে রোমানিয়ার পার্লামেন্টে চতুর্থ বড় পার্টি হিসেবে জায়গা করে নেয়। এখানেও উগ্র-ডানপন্থার উত্থানে কভিড-১৯ বড় ভূমিকা রেখেছে। 

ফ্রান্সে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বিরুদ্ধে উগ্র-ডানপন্থী নেতা ম্যারিন লে পেনের রেকর্ড পরিমাণ উত্থানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতালিতে উগ্র-ডানপন্থী দল ফ্রাতেলি ডি’ইতালিয়া তাদের সমর্থন দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়েছে। এক বছর আগে যেখানে তারা ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে, সেখানে এখন তাদের পকেটে রয়েছে ১৫ শতাংশের ভোট। বেলজিয়ামে উগ্র-ডানপন্থী দল ভ্লামস বেলাংয়ের রয়েছে ২৬.৩ শতাংশ ভোট, যা তাদের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ অবস্থান। 

ফরাসি রাষ্ট্র বিজ্ঞানী জঁ ইভ কামুর মতে, ইউরোপজুড়ে উগ্র-ডানপন্থার জন্য করোনাভাইরাসকে দায়ী করাটা হবে অতিসরলীকরণ। তিনি বলেন, পর্তুগিজরা চেগা পার্টিকে ভোট দেয়ার অন্যতম কারণ- দেশটির প্রেসিডেন্টের চরিত্র যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তারা লকডাউন পছন্দ করেনি বলে ওই দলটিকে ভোট দিয়েছে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে লে পেনের সমর্থন বৃদ্ধির একটি বড় কারণ- সংকট মোকাবেলায় সরকারি বাজে ব্যবস্থাপনা। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। ফ্রান্সে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে অর্থনীতি ও অপরাধও বড় ইস্যু। সেইসাথে সেক্যুলারিজমও এ সময়ে ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ নিজস্ব ইস্যু। এদিকে, এস্তোনিয়ায় ভক্স ও লে পেনের শরিক দল সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তা উগ্র-ডানপন্থীদের জন্য এক বড় আঘাতও বটে!

ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট র‌্যাসিজমের (ইএনএআর) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জুলিয়ানা সান্তোস ওয়ালগ্রেন বলেন, উগ্র-ডানপন্থীদের বক্তব্য সবসময় একইরকম থাকে, শুধু ইস্যু পরিবর্তিত হয়। কখনো এখানে অর্থনৈতিক, আবার কখনো শরণার্থী ইস্যু সামনে আসে। এখন রয়েছে স্বাস্থ্য খাত, যা কাটাছেঁড়ায় মগ্ন ডানপন্থীরা। মহামারি নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছ নীতির অভাব ও প্রচুর ভ্রান্তিকর তথ্য উগ্র-ডানপন্থীদের বিষাক্ত বার্তা ছড়ানোর উর্বর ভূমি প্রস্তুত করেছে। 

সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের কথা ম্যাখোঁ তার বক্তব্যেও একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। ফ্রান্সের অন্যান্য পার্টিও একই ধরনের কথা বলেছে বিভিন্ন সময়ে। তাই এটি এখন আর শুধু উগ্র-ডানপন্থীদের বিষয় থাকছে না। সীমান্তের ওপারে বেলজিয়ামে একই কাজ করে যাচ্ছে ভ্লামস বেলাং। সেখানকার সাংবাদিক ইসোল্ডে ভান দেন আইডে বলেন, যেমনটা দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালে হয়তো ভ্লামস বেলাং ক্ষমতায় আসতে পারে। এখনো পর্যন্ত মূলধারার কোনো দলই তাদের ক্ষমতার অংশীদার করতে রাজি নয়। তাই তারা এককভাবে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা করেছে।

উগ্র-ডানপন্থার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে শুধু অর্থনীতি নয়, গণতন্ত্রের ওপর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কোনোটির শাসক কর্তৃত্ববাদী হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে। ইউরোপ বর্তমানে আত্মকেন্দ্রিকতার উত্থানের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপ দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হলে, পুরো বিশ্বই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপজুড়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ডানপন্থার উত্থান ঘটলেও, এখনই তারা ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম নয়। তবে এ উত্থানের ফলে মূলধারার রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসছে, যা হয়তো বছর দশেক পর পুরো মহাদেশকেই এক ভিন্ন অবস্থানে এনে দাঁড় করাবে। উগ্র-ডানপন্থার সংকট মহামারির কারণেই শুরু হয়নি। আর্থিক মন্দা, শরণার্থী সংকট, যুদ্ধ এর সাথে জড়িত। মহামারি এসব সংকটকে আরো দ্রুত সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে মাত্র।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //